মোহাম্মদ মাকসুদুল হাসান ভূঁইয়া রাহুলঃ
টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ৩৬ বছরের আক্ষেপ ঘুচানোর আশা নিয়ে কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে হাজির হয়েছিল টিম আর্জেন্টিনা। এ দলের প্রাণভোমরা অধিনায়ক লিওনেল মেসির নেতৃত্বে অধরা সোনালি ট্রফি ঘরে ফিরবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর সতীর্থ ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আলবিসেলেস্তে সমর্থকদের।
এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচ ছিল সৌদি আরবের সঙ্গে। অনুমেয় ছিল, আরবের দেশটিকে সহজেই পরাস্ত করবেন মেসি বাহিনী। প্রথমার্ধে দাপটের সঙ্গে খেললেও দ্বিতীয়ার্ধে খেই হারিয়ে বসে টিম আর্জেন্টিনা। ম্যাচ হেরে যায় ২-১ গোলে! বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যয়ে কাতারে আসা আলবিসেলেস্তেদের জন্য এ ছিল বিশাল ধাক্কা!
সৌদির সঙ্গে হেরে যাওয়ার পর চতুর্দিক থেকে সমালোচনার তীর আসতে থাকে মেসিদের দিকে। শুরু হয় অবজ্ঞা! রব উঠে ‘হ্যোয়ার ইজ মেসি’, ‘হোয়্যার ইজ মেসি’! তবে সমালোচনা আর অবজ্ঞার চাপে দমে যাননি ফুটবল জাদুকর! বরং সমর্থকদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে সমর্থকরা যেনো মেসিদের উপর বিশ্বাস রাখেন। কারণ তাদের হতাশ হতে দেবেন না মেসিরা!
সমর্থকদেরকে দেয়া কথার ব্যত্যয় করেন নি ফুটবল জাদুকর ও তাঁর সতীর্থরা। নিজেদের পরবর্তী ম্যাচে মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে দাপটের সঙ্গে পরাজিত করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলোয় পৌঁছায় আলবিসেলেস্তেরা। এই পর্বে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। নক-আউট পর্বের ওই খেলায় অজিদের হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনা। সেখানে তারা মুখোমুখি হয় শক্তিশালী নেদারল্যান্ডসের। ম্যাচের শুরুতে মেসিরা ২-০ গোলের লিডে থেকেও খেলার মূল সময় শেষে স্কোর দাঁড়ায় ২-২! ফলাফল টাইব্রেকার। আর্জেন্টিনার ভরসা তখন দলটির গোলবারের দেয়াল এমিলিয়ানো মার্টিনেজ! তাঁর সুনিপুণ দক্ষতায় ৪-৩ গোলের ব্যবধানে ডাচদের বিপক্ষে জয় নিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যায় আলবিসেলেস্তেরা।
সেমিতে আর্জেন্টিনার সামনে তখন এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল ক্রোয়েশিয়া। তবে বিশ্বজয়ের মিশন নিয়ে কাতারে আসা উজ্জীবিত মেসিদের সামনে টিকতে পারেনি ২০১৮ বিশ্বকাপের রানার্স আপরা। হেসেখেলেই ক্রোয়েটদের ৩-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে পা দেয় দারুণ ছন্দে থাকা মেসি বাহিনী।
প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত হারের পর যেই সমালোচনা শুরু হয়েছিল, সেই তীর্যক শব্দগুলো যে মেসিদের জয়ের ক্ষুধা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! সোনালি ট্রফির স্পর্শ থেকে মেসিরা তখন মাত্র এক ম্যাচ দূরে। তাদের সামনে এবার গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। লাতিন ও ইউরোপীয়দের ফাইনাল ঘিরে তখন বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা! একদিকে বিশ্বজয়ের মিশনে থাকা আলবিসেলেস্তে, অন্যদিকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফরাসিদের মধ্যকার এই শিরোপার লড়াইটা যে জমজমাট রূপ নেবে, এমনটাই ধারণা ছিল।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। পুরো বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের দৃষ্টি তখন ধূসর মরুর বুকে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা লুসাইল স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায়! তবে খেলার প্রথমার্ধ ছিল একবারেই একপেশে! সোনালি ট্রফি ঘরে নিতে আসা মেসি বাহিনীর কাছে একেবারেই অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে এমবাপ্পে, গ্রিজম্যানরা! প্রথমার্ধের শেষে ২-০ তে এগিয়ে যায় মাস্টারমশাই নিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা। মেসি পেনাল্টি থেকে ও দলের তুরূপের তাস এঞ্জেল ডি মারিয়া ফ্রান্সের জালে বল জড়ান। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেও আর্জেন্টাইন আক্রমণে কাঁপতে থাকে ফরাসি সীমানা!
ফ্রান্স টিমকে ততক্ষণে প্রায় পাড়ার টিম বানিয়ে ফেলে মেসি বাহিনী। আলবিসেলেস্তের ছন্দপতন হয় দলের অন্যতম ভরসা ডি মারিয়াকে ৬৫ মিনিটে মাঠ থেকে তুলে নেয়ার পর। এসময় আর্জেন্টাইন আক্রমণ কিছুটা স্তিমিত হয়। সুযোগ কাজে লাগায় ফরাসিরা। পেনাল্টি থেকে গোল আদায় করে নেন ফ্রান্সের তরুণ তুর্কি কিলিয়ান এমবাপ্পে! পরবর্তী ৯৭ সেকেন্ডের মাথায় এমবাপ্পের জোরালো আরেক শটে ২-২ গোলের সমতায় ফেরেন তারা। ফরাসিদের এমন হঠাৎ প্রত্যাবর্তনে আর্জেন্টিনা হচকিয়ে যায় কিছুটা! খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে!
৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে যাওয়া মাহেন্দ্রক্ষণ কি আরো দীর্ঘায়িত হবে, এমন আশঙ্কার কালোমেঘ তখন নিশ্চয়ই দেখা দিয়েছিল আকাশী-নীল শিবিরে! অতিরিক্ত সময়ের ১০৯ মিনিটে এবার জাদুকর মেসির ঝলকানি! ফরাসি গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে আদায় করে নেন গোল! উঁকি দেয় আশার সূর্যকিরণ! তবে ম্যাচটা যেহেতু ফাইনাল, সৃষ্টিকর্তা তখনো অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা সাজিয়ে রেখেছিলেন! ১১৫ মিনিটের মাথায় আবারো পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। দারুণ ফর্মে থাকা এমবাপ্পে সেই শট নেন, আদায় করেন নিজের হ্যাট্রিক, দলকেও ফেরান সমতায়।
খেলার ১২০ মিনিট শেষে যোগ করা সময়ের প্রায় শেষ মুহূর্তে যখন রেফারির বাঁশির অপেক্ষায় সবাই, তখন ফরাসি খেলোয়াড় মাউনি আর্জেন্টাইন গোলরক্ষককে একা পেয়ে গোলবার বরাবর নেন জোরালো এক শট! তবে ইতিহাসটা এবার যে অন্যরকম লিখে রেখেছিলেন সৃষ্টিকর্তা! নিশ্চিত হতে যাওয়া গোলকে মার্টিনেজ দারুণ দক্ষতায় পা বাড়িয়ে রুখে দেন! যদি শেষ মুহূর্তে এই গোলটা হয়ে যেতো, তবে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা ঘরে তোলার অপেক্ষা আরো দীর্ঘ হতো আলবিসেলেস্তেদের!
বিশ্বকাপের ফাইনালের মতন বড় ম্যাচ! তার উপর ৩৬ বছর কাপ খরা! প্রত্যাশার এই চাপকে দারুণভাবে সামলে নেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ! ফলাফল নির্ধারনী পেনাল্টি শুট আউটে ফ্রান্সের এমবাপ্পে গোল করতে পারলেও, ফ্রান্সের কিংসলে কোমানের শট ঠেকিয়ে দেন বাজপাখি খ্যাত মার্টিনেজ। উজ্জীবিত আর্জেন্টাইন গোলরক্ষকের সামনে ভড়কে গিয়ে তৃতীয় শটে ফরাসি খেলোয়াড় চুয়ামিনি বল মারেন গোলবারের বাইরে দিয়ে। এদিকে নিজেদের প্রথম ৩টি শুটেই গোল আদায় করে নেন লিওনেল মেসি, পাওলো দিবালা ও লিয়েন্দ্রো পারাদেস। গঞ্জালো মন্ট্রিয়েল চতুর্থ শটে ফ্রান্সের গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল জালে পাঠিয়ে দেন, সৃষ্টি হয় নতুন মহাকাব্য, চ্যাম্পিয়নের স্বর্ণালি তালিকায় উঠে যায় আলবিসেলেস্তেদের নাম!
মরুর বুকে আর্জেন্টাইন এই রূপকথা রচনার মহানায়ক একজনই, তিনি লিওনেল মেসি। ইতিহাসের পাতায় পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে তিনি তাঁর দলকে নিয়ে লিখে ফেলেছেন এক মহাকাব্য! এই অর্জনে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। তিনি আশা জাগিয়েছেন, আলবিসেলেস্তেরা অবশ্যই পারবেন ৩৬ বছরের না পাওয়াকে পূর্ণতা দিতে, অধরা স্বপ্নকে বাস্তব করতে। সতীর্থদের তিনি এতটাই ভালোবেসেছেন, তাদের প্রতি এতটাই আস্থা রেখেছেন যে তাঁরা এই মানুষটার জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন মাঠে! দলনেতার প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধা, আনুগত্য নিয়ে তাঁরা মাঠের খেলায় মনোযোগী হয়েছেন, পারফর্ম করেছেন নিজেদের সবকিছু উজাড় করে, ইতিহাস গড়ে নাম লিখিয়েছেন সোনালি ট্রফিতে!
মেসির কাছে ফুটবলের ব্যক্তিগত ও দলগত সব অর্জনই ছিল। ছিল না শুধু একটা বিশ্বকাপ। তবে ফুটবলে তাঁর যা অর্জন, তাতে তিনি নিঃসন্দেহে ফুটবল ইতিহাসে গ্রেটেস্ট অব অল টাইম। কিন্তু নিন্দুকদের অভিযোগ ছিল, বিশ্বকাপ ট্রফি যার নেই, সে সেরা নয়! যদিও নিন্দুকের কথায় মেসির অর্জন খাটো হয়ে যায় না, তবে বিশ্বকাপ জয়ের শর্ত যেহেতু জুড়ে দেয় বারবার সমালোচকেরা, তবে সেই কটাক্ষেরও অবসান হোক! ফুটবল বিধাতা যেই মানুষটাকে ফুটবলের এত সব অর্জনের মালিক বানিয়েছেন, সেই জাদুকরকে কেনইবা বিশ্বকাপ বঞ্চিত রাখবেন তিনি!
কাতার বিশ্বকাপে দেশের ও নিজের বিশ্বকাপ অর্জনের নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন মেসি। ফুটবল বিশ্বমঞ্চের ১২০ গজে তাঁর এবারের পারফর্মেন্স ছিল বিগত সকল সময়ের সেরা! ভাষার অভিধানে এমন কোনো গুণবাচক শব্দ নেই, যা দিয়ে মেসির মন্ত্রমুগ্ধ পারফর্মেন্স বর্ণনা করা যায়! বিশ্বকাপের ইতিহাসে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল পাওয়া একমাত্র ফুটবলার তিনি। গোল করে শুধু নিজের ব্যক্তিগত রেকর্ডের ঝুলি ভারী করেন নি, সতীর্থদের দিয়েও গোল করিয়েছেন। এই বিশ্বকাপে ৫ বার হয়েছেন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। ২০১৪ বিশ্বকাপের মত কাতার বিশ্বকাপেও পারফর্মেন্স দিয়ে জিতে নিয়েছেন গোল্ডেন বল পুরস্কার! দুই বিশ্বকাপে এই পুরস্কার নিজের শোকেসে তোলার রেকর্ডের একচ্ছত্র অধিপতি এখন শুধুই মেসি!
প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের সঙ্গে হারের পর ব্যাঙ্গাত্মক কথার তীর সবচেয়ে বেশি বিদ্ধ করেছে ফুটবল কিংবদন্তি লিওনেল মেসিকে। বাঁকা সুর উঠেছিল ‘হ্যোয়ার ইজ মেসি’, হ্যোয়ার ইজ মেসি! তবে এই অবজ্ঞার জবাব মুখে নয়, সর্বকালের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি বিশ্বকাপের সবুজ গালিচায় নিজের পায়ের জাদুতেই লিখেছেন, ‘দ্যা গ্রেটেস্ট ফুটবলার অব অলটাইম, দ্যা কিং লিওনেল মেসি ইজ হ্যায়ার!’